বাগান
-শম্পা সাহা
শ্বাশ্বতী রায় জীবনটা শুরু করেছিলেন আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতই। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, তারপর বাংলা অনার্স আর তারপর ভালো চাকুরে দেখে বিয়ে।
সাধারণ চেহারার মধ্যেও শ্বাশ্বতীর কোথাও যেন বিশেষ একটা কিছু ছিল ওই যাকে বলে এক্স ফ্যাক্টর। তাই শ্যামলা শ্বাশ্বতী যখন চওড়া পাড় তাঁত আর একটা বিরাট এলোখোঁপা করে তাতে ফুল গুঁজতো আর কপালে বেশ চাঁদের মত ভেলভেটের টিপ, চোখ ফেরানো মুশকিল ছিল আট থেকে আশির।
আর একটা বিশেষত্ব ছিল ওর সাজগোজের।ও বেশ ধ্যাবড়া করে কাজল পড়তো ওই যাকে আজকালকার ঘষামাজা ভাষায় বলে স্মাজ! আসলে ওর চোখ যেন একটু ছোট পানপাতা মুখের তুলনায়। মা বলতো হাতির চোখ, বোন বলতো, কুতকুতে। সেটা ঢাকতেই এই স্টাইলটা বেশ ক্র্যাক করে যায়।
অফিস টফিসে শ্বাশ্বতীর বর বেশ ঠ্যালাও খায়,”কি রায়দা বৌদি কেমন আছে? সত্যি দাদা ভাগ্য করে বৌ পেয়েছ!” বা,”বৌদি কি দেখে যে তোমায় বিয়ে করলো?” ঢং ..যেন জানে না, আমাদের দেশে এখনো ছেলেরা বিয়ে করে আর মেয়েদের হয়, তাই বৌদির বিয়ে করার প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?আজকাল হলেও না হয় কথা ছিল! এ নব্বইয়ের দশক। না এসব রায়বাবু কিছুই বলেন না।
বাড়িতে এসে দেখেন বৌদি একঢাল চুলে লম্বা একটা বেনী করে, সাধারণ সুতির শাড়ি আর কপালে সিঁদুরের লাল টিপ। ভেলভেট পড়লে নাকি আঠায় কপাল কুটকুট করে।আগে এসব দেখে রায়দার বেশ একটু ইয়ে মতন হতো। মাঝে মাঝে মনে হত চকাস করে একটা চুমু খাই, বা নিদেন একটু আঁচল টেনে গদগদ স্বরে বলি, “এই একটু এদিকে এসো না!” কিন্তু তখন তো সন্ধ্যা হতেই মা টিভির ঘরে, রাজ্যের খাজা বাংলা সিরিয়াল নিয়ে।তবে এতো না হলেও হাবিজাবি অনেক কিছুই ছিল। আর আসতো মায়ের আড্ডার বন্ধুরা। মানে পাশের বাড়ির কাকিমা, ওপাড়ার জ্যেঠিমা, সামনে বাড়ির বৌদি।আর শ্বাশ্বতী লাজুক মুখে চা সাপ্লাই দিয়ে যেত। এককাপ অবশ্য রায়দার-ও জুটতো।
তারপর বয়স বাড়লে বসতো ভগবতের আসর। ঠাকুরের নাম, মালা জপা। আর শ্বাশ্বতীও সেই চায়ের দায়িত্বে। সঙ্গে ততদিনে দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, তাদের টিফিন করে দেওয়া।
কিন্তু সব সময় শ্বাশ্বতী একই রকম। যদিও এখন ছেলে মেয়ে বড় হওয়ায়, বয়সের কারণে শরীর ভারী হয়েছে কিন্তু ওই যে কি যেন আছে ওর মধ্যে।
এই তো মাস খানেক আগে অফিসের গেট টুগেদারে, ফিচকে ছোঁড়া অতনু তো বলেই বসলো,”যাই বলো রায়দা তোমাকে বৌদির পাশে পুরো কাকু মনে হয়।” এমনকি এই কথা শুনে শ্রাবন্তী পর্যন্ত হেসে কুটিপাটি।শ্রাবন্তী নতুন জয়েন করেছে, ঘষামাজা সুন্দরী। রায়দার ওকে বেশ লাগে।
“ওরা কি বুঝবে? সংসার তো চালাতে হয় এই শর্মাকেই। ওদের বৌদিকে তো আর দশটা পাঁচটা অফিস করতে হয় না বাস ঠেঙিয়ে। তাহলে ওই এক্স ফ্যাক্টর কবেই ওয়াই জেড হয়ে যেত!”
কিন্তু সবই মনে মনে। ভদ্রলোকের শতেক জ্বালা, চাইলেও কিছু বলা যায় না।
শুধু বাড়ি ফিরে বৌকে বলেছিল, “এই বয়সে অত মাথায় ফুল লাগাবার কি দরকার!” মাথায় ফুল লাগানোটা শ্বাশ্বতীর নেশা।কোনো অনুষ্ঠানে গেলে মাথায় ফুলটা ওর মাস্ট। তাই বাড়ির বাগানেই হাজার ফুলের মেলা। কিনতেও হয় না। তাই মাথায় ফুল লাগানোর কোনো খরচ নেই, এমনকি বাড়ির পুজোর ফুলের খরচটাও বেঁচে যায়!
সাধারণ দিনেও রাতে একটা ফুল বা মালা গেঁথে মাথার কাছের টেবিলে রাখে শ্বাশ্বতী।যে সময় যে ফুল হয়। মরশুমি গাঁদা থেকে রজনীগন্ধা, বেলি, গ্লাডিওলার, ডালিয়া এমনকি কামিনী গোছাও।
সারাদিন কাজ শেষে, সবাইকে রেডি করে শ্বাশ্বতী লাগে ফুলের পরিচর্যায়। মাটি খুঁড়ে, তাতে সার দিয়ে, পাকা পাতা ফেলে, জল দিয়ে, নোংরা পরিষ্কার করে একেবারে ঝকঝকে তকতকে। ফুলের বাগান তো নয় যেন নিজের সন্তান। গাছগুলোর চারিপাশ আবার নিজে হাতে নিকিয়ে দেয়। কিছু বললে বলে,”আমার তো ওই একটা মাত্র শখ, ওতে আর বারণ কোরো না !” রায়দা বারণও করেন না।
এমনিতেই প্রাইভেট ফার্মের চাকরি, বৌকে তেমন সময় দিতেই বা কোথায় পারেন? কিন্তু আজকাল যেন শ্বাশ্বতীর এই ফুল ফুল বাতিকটা অসহ্য লাগে। রায়দার বয়স প্রায় পঞ্চান্ন, গায়ের রং টকটকে ফর্সা, মনে হয় টোকা দিলে রক্ত বেরোবে। মাথা জোড়া মস্ত টাক, পিছনে অবশ্য কয়েকগোছা চুল আছে কিন্তু তা যতই টেনে সামনে ঢাকার চেষ্টা হোক, সবই ব্যর্থ। অথচ শ্বাশ্বতী! সেই একই রকম চুলের গোছা।
মাঝে মাঝে রাগ হয় রায়দার। ওনার বয়স বাড়ে তাহলে বৌয়ের কেন বাড়বে না।? এই নিয়েও লোকের গা ঠ্যালা কথার শেষ নেই।মোটে তো দশ বছরের বড় কিন্তু লোকে এমন করে বলে যেন শ্বাশ্বতীর ও বাবার বয়সী।আর তার ওপরে ফুল। আজকাল তো অফিসে দুয়েকজন ঠাট্টা করে ওনাকে ফুলকুমার বলে। কি? না বৌদি ফুলকুমারী তাই আপনি ফুলকুমার। আর সহ্য হয় না!
এইবার রায়দা ঠিক করেছেন বাড়ির সামনের ওই বাগানটায় একটা দোকানঘর করবেন। রিটায়ারমেন্ট এর আর বেশিদিন নেই। তাই ওটা ভাড়া দিলে বেশ কিছু ক্যাশ আসবে।
শ্বাশ্বতী বরাবরই চুপচাপ, খুব বেশি কথা বলা ধাতে নেই। ও যেন কোনো কিছুকেই গায়ে মাখে না! না ভালোবাসা না রাগ। তবু দুয়েকবার বলে,
“বাবুর তো চাকরি হয়ে গেছে। সামনে দোকান না করলেই কি নয়। বাগানটা না হয় থাক। পুজোর ফুলটাতো আসে!”
“পুজোর ফুল না তোমার খোঁপার ফুল?”
পরদিন মিস্ত্রী লেগে যায় কাজে। অনেক বেলা হলো, চা পায় নি কেউ। প্রায় নটা বাজে। বাবু এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি।রায়দাকে আবার না ডাকলে ঘুম ভাঙে না।মিস্ত্রীদের আগের দিনই সব দেখিয়েদুখিয়ে দিয়েছিলেন। ওরা সকাল সকাল এসেই কাজে লেগে গেছে।
ঠুকঠাক আওয়াজে রায়দার ঘুম ভাঙে। বৌদি কই? এ ঘর ও ঘর খোঁজেন,
“মা, বাবুর মা কই গো?”
শাশুড়ি মালা জপতে জপতে ইশারা করেন যে তিনি জানেন না। ঘরে এসে শ্বাশ্বতীর ফোনটা খোঁজেন রায়দা, বাইরে গেলে তো ফোন নিয়ে যাবে।
হঠাৎই নিজের ফোন থেকে শ্বাশ্বতীকে একটা ফোন করবেন বলে ফোনটা তুলতেই একটা মেসেজ চোখে পড়ে হোয়াটস অ্যাপ এ।
“যে বাড়িতে আমার জন্য সামান্য একফালি বাগান থাকে না, সে বাড়িতে আদৌ আমার কোনো জায়গা আছে বলে আমার সন্দেহ।আমি দেশের বাড়িতে গেলাম। ওখানে থেকেই বাগান করবো। আমাকে নিতে আসলে শুধু লোকই হাসবে, তাই সে চেষ্টা কোরো না!”
ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়লেন রায়দা। ততক্ষণে বাগানের গাছগুলো তছনছ হয়ে গেছে দোকানঘর হবে বলে।
বেশ লাগলো